চা-শিল্পের অর্থনৈতিক গুরুত্ব
প্রকাশিত হয়েছে : ০৭ সেপ্টেম্বর ২০২৫, ৬:২৯:০৪
বিধান কুমার পাল::প্রথম চা-গাছ রোপণ থেকে ধরলে বাংলাদেশের চা-শিল্পের বয়স ১৭৮ বছর। সুদীর্ঘ এই সময়ে দেশের মানচিত্র বদলেছে দুই বার। তবে চা-শিল্পের অগ্রযাত্রা থামেনি। অমিত সম্ভাবনার অনুপাতে অনেকটা অর্জিত না হলেও এই শিল্পের অর্জনও কম নয়।
১৮০০ শতাব্দীর প্রথম ভাগে ভারতবর্ষের আসাম ও তৎসংলগ্ন এলাকায় চা-চাষ শুরু হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বাংলাদেশের চট্টগ্রাম জেলার কর্ণফুলী নদীর তীরে চা আবাদের জন্য ১৮২৮ খ্রিষ্টাব্দে জমি বরাদ্দ হয়। ১৮৪০ খ্রিষ্টাব্দে চট্টগ্রাম শহরের বর্তমান চট্টগ্রাম ক্লাব-সংলগ্ন এলাকায় একটি চা-বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, যা কুণ্ডুদের বাগান বলে পরিচিত ছিল। দেশ স্বাধীন হওয়ার আগ পর্যন্ত শুধু সিলেট ও চট্টগ্রাম জেলায় চা আবাদ করা হতো, যা যথাক্রমে সুরমা ভ্যালি ও হালদা ভ্যালি নামে পরিচিত।
উনিশ শতকের ষাটের দশককে বলা হয় চা-শিল্পের বিকাশের প্রথম পর্যায়। ১৮৫৪ সালে সিলেটের ‘মালনিছড়ায়’ বাংলাদেশের প্রথম বাণিজ্যিক চা-বাগান প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮৬০ সালে লালাচাঁদ ও মাটিরাঙ্গা নামে আরো দুটি চা-বাগান প্রতিষ্ঠা করা হয়। সিলেটে ১৮৫৬ সালের ৪ জানুয়ারি দেশজ চা-গাছ আবিষ্কৃত হয় এবং এতে ইউরোপীয় চা কর এবং ব্রিটিশ প্রশাসকদের মধ্যে উদ্দীপনা সৃষ্টি হয়। তারা নিশ্চিত হন যে, শিক্ষা ও সংস্কৃতি এবং যোগাযোগের দিক থেকে সিলেটের মতো একটি অগ্রসর এলাকায় চা উৎপাদন বাণিজ্যিক দিক থেকে লাভজনক হবে। সিলেটের তৎকালীন ম্যাজিট্রেট টিপি লারকিন্স বঙ্গদেশের লেফটেন্যান্ট গভর্নরের কাছে লেখা একটি রিপোর্টে উল্লেখ করেন, চাঁদখানি টিলায় প্রাকৃতিকভাবে প্রচুর চা-গাছ জন্মায় এবং এগুলোর গুণাগুণ বিচারের জন্য কলকাতার ভারতীয় কৃষি সমিতির কাছে পাঠানো হয়েছে। তিনি বাংলাদেশের শীর্ষ কর্তাব্যক্তির কাছে অনুরোধ করেন যেন দেশি প্রজাতির চা-গাছ আবিষ্কারক মোহাম্মদ ওয়াসিরকে ৫০ টাকা পুরস্কার দেন। তৎকালীন সময়ে এভাবে একজন দেশীয় ব্যক্তিকে গুরুত্বপূর্ণ অবদানের জন্য স্বীকৃতি দেওয়া হয়।
উনিশ শতকের শেষে সিলেটে চা-শিল্প অন্যতম প্রধান স্থান দখল করে নেয়। ১৮৯৩ সালে সিলেটে প্রায় ২০ কোটি ৬ লক্ষ ২৭ হাজার পাউন্ড চা উৎপাদিত হয়। ১৯০০ সাল পর্যন্ত এই উৎপাদন অব্যাহত থাকে। ১৯০৪-১৯০৫ সালে সিলেটে মোট চা-বাগান ছিল ১২৩টি, এর মধ্যে ৯৫ শতাংশ চা-বাগানের মালিক ছিল বিদেশি।
ব্রিটিশ উপনিবেশ শাসনের পর পাকিস্তান আমলে চা-শিল্প এক নতুন যুগে প্রবেশ করে। এর ক্রমান্বয়ে মালিকানায় এক উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আসে এবং পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতির হাতে চলে যায়। এর অন্যতম প্রধান কারণ ১৯৪৭ সালের দেশ ভাগের ফলে, পূর্ব বাংলার অনেক হিন্দু ও সিলেটের অনেক জমিদার সিলেট পরিত্যাগ করে ভারতে অভিবাসন নেন। তাদের প্রস্থানে সংকটের সৃষ্টি হয়। এই শূন্যতা পূরণে পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতিরা এগিয়ে আসেন। পরবর্তী সময়ে ১৯৫৭ সালে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বাংলাদেশ চা বোর্ডের সভাপতি নির্বাচিত হন। একই সময়ে তিনি চা-শিল্পের তত্ত্বাবধানে ঢাকায় কেন্দ্রীয় কার্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন। এরই ধারাবাহিকতায় ১৯৫৭ সালে বাংলাদেশ চা রিসার্চ ইনস্টিটিউট (ইঞজও) প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৯৬৬ সালের এক পরিসংখ্যানে দেখা যায়, ১১৪টি চা-বাগানের মধ্যে ৫৬টির মালিক পশ্চিম পাকিস্তানি পুঁজিপতি, ৪৭টির মালিক ইউরোপীয় এবং ১১টির মালিক বাঙালি উদ্যোক্তা। পরবর্তী সময়ে ১৯৭১ সালে বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের সময় চা-শিল্পের ব্যাপক ক্ষতি সাধিত হয়। এই শিল্পকে পূর্বের অবস্থায় ফিরিয়ে আনার জন্য ১৯৭২ সালে বাংলাদেশ সরকার একটি কমিটি গঠন করে। চা-শিল্পের উন্নয়নে এ কমিটি নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। পাটের পরেই চা বাংলাদেশের দ্বিতীয় রপ্তানিকারক অর্থনৈতিক ফসল। এই শিল্পে বাংলাদেশের মোট দেশজ উত্পাদনের ১ শতাংশ আসে।
ঐতিহ্যগতভাবে সিলেট একটি চা উৎপাদনকারী এলাকা। বিস্তীর্ণ সুরমা উপত্যকায় সারি সারি চা-বাগানে এবং ক্রান্তীয় বনে ভরপুর। বাংলাদেশে শ্রীমঙ্গলকে চায়ের রাজধানী বলা হয়ে থাকে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১৭২টি বাণিজ্যিক চা-বাগানের মধ্যে সিলেটে ১৫০টির বেশি বাগান রয়েছে। আয়তন ও উৎপাদন উভয়ের ভিত্তিতে এই অঞ্চলটিতে পৃথিবীর সর্ববৃহত্ তিনটি চা-বাগান অবস্থিত। এখানে ৩ লাখের বেশি শ্রমিক কাজ করে। যার ৭৫ শতাংশ হচ্ছে নারী। এই শিল্প বৈশ্বিক চা উৎপাদনের প্রায় ৩ শতাংশ জোগান দেয়। এছাড়াও ৪ মিলিয়নের বেশি লোকের কর্মসংস্থান জোগায়।
চা বাংলাদেশের একটি গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। দেশের জনসংখ্যা বৃদ্ধি ও ক্রমান্বয়ে নগরায়ণের ফলে এবং জনতার শহরবিমুখতার কারণে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বাড়ছে। বিগত তিন দশকে চায়ের অভ্যন্তরীণ চাহিদা বেড়েছে ব্যাপক। জাতীয় অর্থনীতিতে চা-শিল্পের গুরুত্ব অপরিসীম ও সুদূরপ্রসারী। জিডিপিতে এই খাতের অবদান শূন্য দশমিক ৮১ শতাংশ।
লেখক : শিক্ষার্থী, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়